বিজয় কুমার বিশেষ প্রতিনিধি,
একটি জাতির উন্নতির মূল ভিত্তি হলো শিক্ষা। শিক্ষা হলো মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি ও চরিত্র গঠনের প্রধান উপায়। একজন ব্যক্তি যেমন শিক্ষার মাধ্যমে সুশৃঙ্খল, নৈতিক ও দক্ষ হয়ে ওঠে, তেমনি একটি জাতির সার্বিক অগ্রগতি নির্ভর করে তার নাগরিকদের শিক্ষার মানের ওপর।কিন্তু শিক্ষার সাথে সাথে যদি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি না হয় তবে সেই শিক্ষা পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য হুমকী হয়ে উঠে।শিক্ষা শেষে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করাও শিক্ষার অন্যতম গুন।
বর্তমান সময়ে শিক্ষিত তরুণ সমাজের সবচেয়ে বড় সংকটগুলোর একটি হলো শিক্ষা শেষে কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পরও অনেক তরুণ উপযুক্ত চাকরির সুযোগ পাচ্ছে না। এর ফলে তারা হতাশায় ভুগছে এবং সমাজে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন চিন্তার পরিবর্তন এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের পথ খুঁজে বের করা।
শিক্ষা শেষে অনিশ্চয়তা কেন তৈরি হচ্ছে?
বর্তমান সময়ে তরুণ সমাজের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত সমস্যাগুলোর একটি হলো শিক্ষা শেষে কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা। অনেক শিক্ষার্থী বহু বছর ধরে পড়াশোনা শেষ করেও উপযুক্ত চাকরি পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি সমাজে হতাশা, আর্থিক চাপ ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।নিচে কারনগুলো ব্যাখ্যা করা হলো।
শিক্ষার সঙ্গে চাকরির বাজারের অসামঞ্জস্য:
বাংলাদেশসহ অনেক দেশে শিক্ষাব্যবস্থা এখনো তাত্ত্বিক জ্ঞানভিত্তিক। কিন্তু চাকরির বাজারে চাহিদা থাকে বাস্তব দক্ষতার ওপর। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত জ্ঞান ও বাজারের প্রয়োজনের মধ্যে একটি বড় ফাঁক তৈরি হয়। এই অসামঞ্জস্য তরুণদের কর্মসংস্থানে বাধা সৃষ্টি করে।
দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি:
অনেক শিক্ষার্থী শুধু একাডেমিক ডিগ্রি অর্জন করে থেমে যায়। কিন্তু আধুনিক কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজন যোগাযোগ দক্ষতা, কম্পিউটার জ্ঞান, প্রযুক্তি ব্যবহার, নেতৃত্বগুণ ও সৃজনশীল চিন্তা। এই দক্ষতাগুলোর অভাবে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির কারণে অনেক পুরনো চাকরি হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন চাকরি তৈরি হলেও সেগুলোর জন্য প্রয়োজন উন্নত প্রযুক্তিগত জ্ঞান, যা অনেক শিক্ষার্থীর নেই। এতে তারা পিছিয়ে পড়ছে।
চাকরির সুযোগ সীমিত:
প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে, কিন্তু নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার খুবই কম। সরকারি চাকরিতে সুযোগ সীমিত, আর বেসরকারি খাতেও স্থায়ী চাকরির সংখ্যা দিন দিন কমছে। ফলে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, অনিশ্চয়তাও বাড়ছে।
উদ্যোক্তা মানসিকতার অভাব:
আমাদের সমাজে এখনো “চাকরি পাওয়া”কে সফলতার একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে দেখা হয়। ফলে তরুণরা স্বনির্ভর হওয়ার বা উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা করে না। এই মানসিকতার কারণে তারা বিকল্প কর্মসংস্থানের পথ তৈরি করতে পারে না।
দুর্বল ও সনদকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা:
বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যে অন্যতম সমালোচনা রয়েছে তা হলো — এটি দুর্বল ও সনদকেন্দ্রিক (Certificate-oriented) হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ, শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য — জ্ঞান, দক্ষতা ও মূল্যবোধ অর্জন — অনেকাংশে হারিয়ে গিয়ে এখন মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে শুধু সনদ বা ডিগ্রি অর্জন। এই প্রবণতা শিক্ষার মান ও কার্যকারিতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
চাকরিনির্ভর মানসিকতা:
শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জীবন গঠনের জন্য প্রস্তুতি, কিন্তু আমাদের সমাজে শিক্ষার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে “চাকরি পাওয়া”। তাই শিক্ষার্থীরা এমন বিষয় বেছে নেয় যেগুলোতে চাকরি পাওয়া সহজ মনে হয়, জ্ঞানার্জনের জন্য নয়। ফলে সনদ পাওয়া গেলেও বাস্তব কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।
শিক্ষা শেষে অনিশ্চয়তা: কর্মসংস্থানের বিকল্প পথ কী কী হতে পারে:
বর্তমান সমাজে শিক্ষিত তরুণদের অন্যতম বড় সমস্যা হলো শিক্ষা শেষে কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা। বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের সনদ অর্জনের পরও অনেকেই উপযুক্ত চাকরি পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে চাকরির উপর নির্ভর না করে বিকল্প কর্মসংস্থানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। তাছাড়া দিন দিন আমাদের বেকার সমস্যা বেড়েই চলবে।
শিক্ষার সঙ্গে চাকরির বাজারের অসামঞ্জস্য দূরীকরণ:
বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো শিক্ষাব্যবস্থা ও চাকরির বাজারের মধ্যে অসামঞ্জস্য। একদিকে শিক্ষার্থীরা ডিগ্রি অর্জন করছে, অন্যদিকে চাকরির বাজারে উপযুক্ত দক্ষ জনবল পাওয়া যাচ্ছে না। এই ব্যবধান দূর করতে হলে কিছু কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত শুধুমাত্র তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়, বরং বাস্তব ও ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জন। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ, সৃজনশীল চিন্তা, সমস্যা সমাধান ও উদ্যোক্তা শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রতিটি বিষয়ে বাস্তব প্রয়োগের অংশ রাখতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা কাজের জন্য প্রস্তুত হয়।
শুধু সাধারণ শিক্ষা নয়, কারিগরি শিক্ষা ও টেকনিক্যাল ট্রেনিং বাড়াতে হবে। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ভোকেশনাল স্কুলের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে অন্তত একটি ব্যবহারিক দক্ষতা শেখানো উচিত—যেমন ডিজিটাল মার্কেটিং, প্রোগ্রামিং, ইলেকট্রিক কাজ, গ্রাফিক ডিজাইন, কৃষি প্রযুক্তি ইত্যাদি।
চাকরির বাজার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু অনেক শিক্ষাক্রম এখনো পুরনো। পাঠ্যবই ও পাঠ্যসূচি নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি, উদ্ভাবন, উদ্যোক্তা শিক্ষা, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) সম্পর্কিত বিষয় সংযোজন করতে হবে। উন্নত দেশগুলিতে গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমেই নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা ও উদ্ভাবনী প্রকল্প চালু করতে হবে। শিক্ষার্থীদের নতুন ধারণা ও স্টার্টআপের সুযোগ দিতে হবে।
উদ্যোক্তা সৃষ্টি: উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত তৈরি করতে হবে:
বর্তমান বিশ্বে উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো উদ্যোক্তা সৃষ্টি। একবিংশ শতাব্দীতে যে দেশগুলো দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তারা কেবল চাকরিনির্ভর জনগোষ্ঠী নয়, বরং উদ্যোক্তা-নির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এটি হতে পারে টেকসই উন্নয়ন ও বেকারত্ব নিরসনের অন্যতম পথ।
উদ্যোক্তারা নতুন ব্যবসা, পণ্য বা সেবা তৈরি করে দেশের উৎপাদনশীলতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ান। তারা শুধু নিজের কর্মসংস্থান তৈরি করেন না, বরং অন্যদের জন্যও কর্মের সুযোগ সৃষ্টি করেন।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (SME) খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় অংশ, যা উদ্যোক্তাদের অবদানের কারণেই টিকে আছে। শিক্ষিত তরুণদের অনেকেই চাকরির জন্য অপেক্ষা করে সময় নষ্ট করে। অথচ তারা যদি উদ্যোগ নিতে পারে, তবে নিজের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারবে। ছোট ব্যবসা, স্টার্টআপ, ফ্রিল্যান্সিং, অনলাইন ব্যবসা কিংবা কৃষিভিত্তিক উদ্যোগ তরুণদের বেকারত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারে। এতে সমাজে কর্মসংস্থান বাড়ে, আয় বৃদ্ধি পায়, এবং দারিদ্র্য কমে।
নারী উদ্যোক্তাদের অন্তর্ভুক্তি করতে হবে। নারী উদ্যোক্তারা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। তাঁদের জন্য প্রশিক্ষণ, ঋণ সুবিধা, ও বাজারে অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়াতে হবে। এতে নারীর ক্ষমতায়ন যেমন বাড়বে, তেমনি পারিবারিক ও জাতীয় অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।
উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকারের ভূমিকা ও পৃষ্ঠপোষকতা:
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উদ্যোক্তাদের ভূমিকা অপরিসীম। তবে উদ্যোক্তাদের সাফল্যের জন্য শুধু ব্যক্তিগত উদ্যোগ যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন সরকারের সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা। সরকার যদি উদ্যোক্তাদের জন্য সঠিক পরিবেশ, সুযোগ ও দিকনির্দেশনা দিতে পারে, তাহলে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে এবং অর্থনীতি হবে আরও শক্তিশালী।
উদ্যোক্তা হওয়ার প্রথম ধাপ হলো পুঁজি। কিন্তু নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক ঋণ পাওয়া প্রায়ই কঠিন হয়। সরকার যদি সহজ শর্তে ঋণ, সুদমুক্ত বা স্বল্পসুদের ঋণ, এবং স্টার্টআপ ফান্ড প্রদান করে, তবে তরুণ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সহজেই উদ্যোগ নিতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (SME) খাতের জন্য আলাদা তহবিল গঠন করা যেতে পারে। অনেক তরুণের উদ্যোগ নেয়ার আগ্রহ আছে, কিন্তু অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অভাব রয়েছে। সরকার যদি নিয়মিতভাবে উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ, ব্যবসা ব্যবস্থাপনা, মার্কেটিং, ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়, তাহলে নতুন উদ্যোক্তারা বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। বাংলাদেশে যেমন “Youth Entrepreneurship Program” বা “Skills for Employment Investment Program (SEIP)” রয়েছে, সেগুলোর পরিধি আরও বাড়ানো দরকার।
নতুন উদ্যোক্তারা প্রায়ই তাদের পণ্য বা সেবা বিক্রির উপযুক্ত বাজার খুঁজে পায় না। সরকার যদি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ, মেলা আয়োজন, রপ্তানি প্রণোদনা ও বাজার সংযোগ বাড়ায়, তাহলে উদ্যোক্তারা তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারবে। বিশেষ করে স্থানীয় কৃষি, হস্তশিল্প ও প্রযুক্তিভিত্তিক পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। সরকার যদি একস্টপ সার্ভিস (One-stop Service) ব্যবস্থা চালু করে, তাহলে উদ্যোক্তারা সহজেই ব্যবসা নিবন্ধন ও পরিচালনা করতে পারবেন।
নারীরা উদ্যোক্তা হতে গেলে প্রায়ই সামাজিক ও আর্থিক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে।সরকার যদি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা ঋণ তহবিল, বাজার সুবিধা, ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি তৈরি করে, তবে নারীরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেশি অংশ নিতে পারবে। এতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র—তিনটিতেই ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
শিক্ষা শেষে চাকরি না পেলেও হতাশ হওয়ার কিছু নেই—কারণ কর্মসংস্থানের বিকল্প পথ অসংখ্য। দক্ষতা উন্নয়ন, উদ্যোক্তা হওয়া, অনলাইনভিত্তিক কাজ এবং স্থানীয় সম্পদকে কাজে লাগিয়ে আত্মনির্ভরতা অর্জন সম্ভব। রাষ্ট্র যদি এসব উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দেয়, তবে তরুণ প্রজন্মই হবে দেশের উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি। শিক্ষা আমাদের চিন্তার সীমানা প্রসারিত করার মাধ্যম। তাই অনিশ্চয়তাকে ভয় না পেয়ে, একে একটি সুযোগ হিসেবে নেওয়া উচিত। নিজের প্যাশনকে পেশায় রূপান্তর করতে পারলেই জীবন হয়ে উঠবে অর্থবহ ও গতিশীল। আমাদের উচিত প্রচলিত পথের পাশাপাশি অসংখ্য বিকল্প পথকেও স্বাগত জানানো—কারণ ভবিষ্যৎ সেখানেই উজ্জ্বল।
বিজয় কুমার
শিক্ষক ও লেখক