বিজয় কুমার,বিশেষ প্রতিনিধি :
বাংলাদেশের কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতে ধান একটি গুরুত্বপূর্ণ শস্য। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কৃষিজমি কমে যাওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উচ্চ ফলনশীল ধানের দিকে ঝুঁকছে দেশ। ইরি ধান (বোরো মৌসুমে চাষযোগ্য উচ্চ উৎপাদনশীল ধান) এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় সমাধান। ইরি ধান শুধু একটি ফসল নয়, বাংলাদেশের কৃষি বিপ্লবের একটি হাতিয়ার। এটি শুধু উৎপাদনই বাড়ায়নি, কৃষকদের আয় ও দেশের খাদ্য সংকট মোকাবিলায় নতুন আশার সঞ্চার করেছে।
ইরি ধানের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর উচ্চ ফলনশীলতা। সাধারণ ধানের তুলনায় ইরি ধান হেক্টরপ্রতি ৬-৮ টন পর্যন্ত উৎপাদন দেয়, যা খাদ্য ঘাটতি পূরণে সহায়ক। এছাড়া, এটি বোরো মৌসুমে চাষযোগ্য হওয়ায় সারা বছরই ধান উৎপাদনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ইরি ধান চাষে সাফল্য দেখিয়েছে, যা খাদ্যে স্বনির্ভরতার দিকে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) তথ্য অনুযায়ী, ইরি ধানের কল্যাণে দেশ এখন চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কাছাকাছি পৌঁছেছে।
ইরি ধান বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তায় বিপ্লব এনেছে, তবে এর চাষাবাদে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। ইরি ধান চাষে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন—সেচের পানির অপর্যাপ্ততা, উচ্চমূল্যের বীজ ও সার, এবং পোকার আক্রমণ। এসব সমস্যা সমাধানে সৌরশক্তি চালিত সেচ পাম্প, সহজ শর্তে কৃষি ঋণ এবং গবেষণাভিত্তিক উন্নত বীজের ব্যবহার জরুরি। এছাড়া, কৃষকদের সমবায় পদ্ধতিতে সংগঠিত করলে উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব।
ইরি ধানের সম্প্রসারণ বাংলাদেশকে ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন কৃষি নীতিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, গবেষণা বিনিয়োগ এবং বাজার ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ। যদি সরকার, কৃষক ও বেসরকারি খাত একসাথে কাজ করে, তাহলে ইরি ধান বাংলাদেশকে খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নতুন দিগন্তে নিয়ে যাবে।
ইরি ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি অনেকাংশে কমেছে। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত চাল দেশের মোট চাহিদা পূরণে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। এর ফলে আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কমেছে এবং স্বনির্ভরতার পথ সুগম হয়েছে। ইরি ধানের অধিক ফলন বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে সাহায্য করছে। কৃষকরা অধিক ফলনের কারণে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে। তাছাড়া প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাল উৎপাদনের ফলে ভবিষ্যতে চাল রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।আবার চাষাবাদ, ফসল সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণে কর্মসংস্থান বাড়ছে। সঠিক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির ব্যবহারে ইরি ধান চাষ পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই কৃষি চর্চার পথ খুলে দিচ্ছে।
সরকার ঘোষণা দিয়েছে ৩২ টাকা কেজি দরে অর্থাৎ ১২৮০ টাকা মণ দরে ৫ লাখ টন ধান কিনবে । গতবার ৩০ টাকা দরে কেনা হয়েছিল। সে হিসাবে এবার প্রতি কেজিতে দুই টাকা বাড়ানো হয়েছে। তা ছাড়া গতবারের চেয়ে এবার এক লাখ টন বেশি ধান কেনা হবে। আগামী ৭ মে থেকে ধান কেনা শুরু হবে ও চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ।
ইরি ধানের দাম কম হওয়ার বিভিন্ন কারন থাকে এর মধ্যে প্রধান কারন হলো সরবরাহ ও চাহিদা ।অর্থাৎ বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন বেশি হলে দাম কিছুটা কমে থাকে। আবার মজুতদারির কারনে ধানের দাম কম থাকে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ায়।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে, যার অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো ইরি ধান চাষ। উচ্চফলনশীল এই ধান দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে এ সাফল্যের পথটি কুসুমাস্তীর্ণ নয়; ইরি ধানে স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে রয়েছে নানামুখী প্রতিবন্ধকতা, যা আমাদের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন ইরি ধান চাষে বড় প্রতিবন্ধক। খরা, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় এবং সময়ের আগেই বা পরে মৌসুমি পরিবর্তন ধানের উৎপাদনকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়। ফলে,সেচ সুবিধার সীমাবদ্ধতা এ চাষাবাদে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক কৃষক পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ায় উৎপাদন ক্ষমতা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেন না।
আবার, উন্নত জাতের বীজ, সার ও কৃষি প্রযুক্তির অভাব এবং সঠিক প্রশিক্ষণের ঘাটতি কৃষকদের উৎপাদনশীলতা হ্রাস করছে। পাশাপাশি, কৃষিঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা জটিলতা এবং উচ্চ সুদের বোঝা কৃষকদের মাথাবব্যথার কারণ। এবং বাজারব্যবস্থার অস্থিরতা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষক ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন, যার ফলে তারা অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
এ ছাড়া শ্রমিক সংকট ও চাষাবাদে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিও ইরি ধান চাষকে অনাকর্ষণীয় করে তুলছে। তরুণ প্রজন্ম কৃষিকাজে আগ্রহ হারাচ্ছে, ফলে ভবিষ্যতে এই খাতে দক্ষ জনবলের অভাব দেখা দিতে পারে।
এই প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে প্রয়োজন কার্যকর নীতি, প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান এবং কৃষকের জন্য বাস্তবভিত্তিক সহায়তা। সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে এসব সমস্যা মোকাবিলা করে ইরি ধানে স্বনির্ভর বাংলাদেশের স্বপ্ন সফল করা সম্ভব।
বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে ইরি ধান এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। উঁচু ফলনশীল এ ধান জাত দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে সহায়ক হয়েছে। তবে কেবল উৎপাদন বাড়ালেই স্বনির্ভরতা নিশ্চিত হয় না; এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন বহুমাত্রিক উদ্যোগ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। তাই এখনই সময়, ইরি ধানে টেকসই স্বনির্ভরতা অর্জনে কিছু বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণের।
ইরি ধানে উন্নত জাত উদ্ভাবন ও কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। কারন,আবহাওয়ার পরিবর্তন ও মাটির প্রকৃতি অনুযায়ী সহনশীল ও অধিক ফলনশীল ধানজাত তৈরি করতে হবে, যাতে কৃষকরা সহজে অভিযোজিত হতে পারেন।
আবার, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন অপরিহার্য। বিশেষ করে সেচনির্ভর এলাকাগুলোতে সেচ সুবিধা সহজলভ্য করতে হবে। সোলার পাম্প, ড্রিপ সেচ কিংবা ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প চালুর মাধ্যমে চাষাবাদকে আরও কার্যকর করা সম্ভব। এবং কৃষকের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা বৃদ্ধি করা দরকার। স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি, মোবাইলভিত্তিক তথ্যসেবা ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার শেখাতে মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণ জোরদার করতে হবে।
কৃষকদের কৃষিঋণ সহজলভ্য ও সুদমুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে করে প্রান্তিক কৃষকরা আর্থিক সংকটে না পড়ে চাষাবাদ চালিয়ে যেতে পারেন। একই সঙ্গে সরকারকে ধান কেনার ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ ও সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ নিশ্চিত করতে হবে।
কৃষিতে দীর্ঘমেয়াদি কৃষিনীতির বাস্তবায়ন ও বাজারব্যবস্থা সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ করে কৃষক যেন সরাসরি বাজারে তার উৎপাদিত ধান বিক্রি করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। সবচেড়ে জরুরি হলো তরুণ প্রজন্মকে কৃষির প্রতি আগ্রহী করতে হবে । কৃষিকে লাভজনক ও মর্যাদাপূর্ণ পেশা হিসেবে তুলে ধরতে হবে। আধুনিক কৃষিশিক্ষা ও উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
ইরি ধান চাষের মাধ্যমে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বনির্ভরতার পথে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। উচ্চফলনশীল জাত, উন্নত প্রযুক্তি ও কৃষকদের নিরলস পরিশ্রমের ফলে ধানের উৎপাদন বেড়েছে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়েছে। এ সাফল্য ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, গবেষণা ও সরকারিভাবে কৃষকদের আরও বেশি সহায়তা। টেকসই কৃষিনীতি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ইরি ধানের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে একটি শক্তিশালী ও স্বনির্ভর অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে তুলতে পারবে।
লেখক: বিজয় কুমার,সাবেক শিক্ষার্থী ,যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।